Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
খবর
বিস্তারিত

বেইলি রোডে আগুন

আমরা জানি, একটি ভবন গড়ে ওঠা থেকে উপযোগিতা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে সরাসরি ছয়টি সরকারি কর্তৃপক্ষ যুক্ত থাকে: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব সেবা সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ভবনের কার্যক্রম চলার কথা। কার্যত সেই নিয়ম মানা হয় না। বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের অসামঞ্জস্যের কারণেও নগরীর অগ্নিঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সমন্বয়হীনতা ও ব্যত্যয়ের আবর্তে বন্দি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণেও হাজার হাজার স্থাপনা ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে থাকে। যেমন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০২৩ সালে দেশের ৫ হাজার ৩৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে ১ হাজার ৬৯৪টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪২৪টি ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণরূপে চিহ্নিত করেছে।

আমরা দেখি, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডেই গাফিলতি ও তদারকির অভাব উন্মোচিত হয়। কিন্তু সেই আলোচনা হয় অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো। কোনো একটি বা দুটি দিকে আলোকপাত করা হয়। সামগ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি আলোচনার বাইরেই রয়ে যায়।


যেমন ছয়টি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এরও সামগ্রিক দিক নিয়ে কি আলোচনা হয়? সংস্থাটির কাজ হলো অগ্নিকাণ্ড রোধে জনসাধারণকে সচেতন এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের জানমাল রক্ষা ও উদ্ধারে জীবন বাজি রেখে কাজ করা; ফায়ারবিষয়ক লাইসেন্স ও ছাড়পত্র প্রদান, নবায়ন করা। সঠিক নিয়মে ফায়ার ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা দেখভাল করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংস্থাটির সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইমারত ও জনসংখ্যা। 


আমরা দেখেছি, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের আগেও এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। যেমন ২০১০ সালের ৩ জুন চানখাঁরপুলের নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ, একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন। এসব দুর্ঘটনায় ৩৩৪ জনের মৃত্যু হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি। কারণ ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩’-এ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা, ২০১৪’ স্থগিত রয়েছে। যে কারণে অগ্নিকাণ্ডজনিত হত্যাকাণ্ড রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা প্রতিষ্ঠানে চিঠি প্রদান ছাড়া তাদের কিছুই করণীয় নেই।
প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনা শেষে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের পর পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত নজরদারি ও তদারকির অভাবে নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভবনের অগ্নিনির্বাপণ সিঁড়ি হয়ে যায় গুদাম কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার রাখার স্থান। স্পিঙ্কলার কিংবা ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম কার্যক্ষম কিনা, ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা, তা সবার অগোচরেই থেকে যায়।

অগ্নিনির্বাপণের প্রাথমিক প্রতিরোধে (গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ১৫ মিনিট) অন্তর্ভুক্ত প্রশিক্ষিত জনবল অর্থাৎ ‘ফায়ার ভলান্টিয়ার’ তৈরির অভাবও বর্তমানে নিদারুণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর দেশব্যাপী প্রায় ৬৫ হাজার ‘আরবান কমিউনিটি লেভেল ভলান্টিয়ার’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও রয়েছে ধারাবাহিকতার অভাব। প্রতিটি জনসমাগম ভবন অথবা শিল্পকারখানায় যদি প্রশিক্ষিত ‘ফায়ার ভলান্টিয়ার’ নিয়োগ দেওয়া যেত, তাহলে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতির সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্যবশত, শিল্প আইনে ১৮ শতাংশ এমন প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের প্রবিধান থাকা শর্তেও তা এখনও তৈরি হয়নি।  

অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এখনও পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। দেশের সব উপজেলা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শিল্প এলাকাকেন্দ্রিক শহর, বেপজা, বেজা, ইপিজেডসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গার জন্য ন্যূনতম ৭৩৫টি স্টেশন প্রয়োজন, যার বিপরীতে বর্তমানে ফায়ার স্টেশন আছে মাত্র ৪৯৫টি। দেশে বর্তমানে থাকা মোট ফায়ার স্টেশনের মধ্যে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত রয়েছে ৯২টি, ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত ২৮৮টি, ‘বি’ স্থল-যুক্ত-নদী স্টেশন ৪টি, ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত ১০০টি এবং নদী ফায়ার স্টেশন ১১টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে প্রতি ৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ অধিবাসীর জন্য মাত্র একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে অনুমোদিত জনবলের মাত্র ৪০ শতাংশ বর্তমানে নিয়োজিত। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি তাদের জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও স্বল্পতা রয়েছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নয়।

দেশজুড়ে অপরিকল্পিত নগরায়ণের চিত্রটি সামনে আসে অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ে। নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান, গণপরিসর ও জলাশয় ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বহুতল ভবনগুলোতে স্থাপিত শপিংমল, রেস্টুরেন্টগুলো হয়ে উঠেছে নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের কেন্দ্রস্থল। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্ট, অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি বা মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থা, ঢাকার আশপাশ এবং মধ্যে জলাশয়ের অভাবে উদ্ধার কার্যক্রমও অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। 

প্রশ্ন হচ্ছে, করণীয় কী? প্রথমত, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণ অনুমোদন এবং ব্যবসায়িক লাইসেন্স অনুমোদনকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি ৬টি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ‘টাস্কফোর্স’ গঠনপূর্বক নগরীতে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিতকরণ এবং তা দ্রুত যথাযথকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে চিহ্নিত ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপদজ্জনক’ ভবনগুলোর হালনাগাদ তালিকা নিয়মিত ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভবনের সামনে দৃশ্যমানভাবে প্রকাশ করতে হবে। 




দ্বিতীয়ত, স্থগিত ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা-২০১৪’ অবিলম্বে অনুমোদন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩’-এর ধারা ১৭ থেকে ২৩ পর্যন্ত বর্ণিত শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে ক্ষমতায়িত করতে হবে।
তৃতীয়ত, ‘ফায়ার লাইসেন্স’ প্রদান কমিটিতে দক্ষ এবং পর্যাপ্ত পেশাজীবীকে অন্তর্ভুক্তকরণের পাশাপাশি  ভবনের ‘প্রতিবছর নবায়নযোগ্য ব্যবহারযোগ্যতা’ সনদ প্রদানের আগে ‘ফায়ার সেফটি অডিট’ নিশ্চিত করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ‘সিভিল ডিফেন্স’ অংশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরির কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

চতুর্থত, ফায়ার স্টেশনবিহীন শিল্পাঞ্চলে জরুরি ভিত্তিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ইতোমধ্যে গৃহীত ‘স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন’ স্থাপন সংক্রান্ত উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে দেশজুড়ে স্থাপিত শিল্পাঞ্চল অগ্নিদুর্যোগ প্রতিরোধে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

পঞ্চমত, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে যুগোপযোগী ও সর্বাঙ্গীণ করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মিত সচেতনতামূলক ‘স্মার্ট’ প্রচার ও জনসংযোগের পাশাপাশি জনস্বার্থে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এবং শিল্পাঞ্চলে ‘ফায়ার ড্রিল’ পরিচালনা করতে হবে।
রাজধানীসহ সব নগর এলাকায় অবিলম্বে অগ্নিঝুঁকিজনিত বিপজ্জনক পরিস্থিতির ওপর সার্বিক সমীক্ষা পরিচালনা এবং এর সম্ভাব্য সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।

স্থপতি ইকবাল হাবিব: সহসভাপতি, বাংলাদেশ
পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)


ছবি
ডাউনলোড
প্রকাশের তারিখ
15/03/2024
আর্কাইভ তারিখ
15/03/2024